হোমিওপ্যাথি, প্ল্যাসিবো ইফেক্ট, ব্যাধি, প্রতারণা ও আমাদের অজ্ঞতা!!
গত ফেব্রুয়ারী মাসে প্রতিদিন নিজের থেকেই অনেক অজানা মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি; এদের কেউই আসলে ভালো নাই, এরা সবাই সবার আপন জনদের নিয়ে ভীষন রকম উদ্বিগ্ন। এদের কেউ বিত্তশালী, কেউ তথাকথিত মধ্যবিত্ত, কেউ নিম্নবিত্ত, কেউ নিম্ন-নিম্নবিত্ত মানে দিনমজুর। হঠাৎ ৯০০০ মাইল থেকে উড়ে গিয়ে এতো স্বল্প দিনে এতো লোকের সাথে পরিচিত হওয়াটা চোখে আঙ্গুল দিয়েই মনে হয় আমাকে বারবার দেখাচ্ছিল আমাদের দৈন্য দশা আর আমাদের অসহায়ত্ব। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আকুতি আসলে অসহনীয়।
এমন একজন মানুষের নাম সাহেব হোসেন্। নোয়াখালীর মাইজদী শহরের আশে পাশে বাড়ি। ৯-১০ মাস আগে ২৩ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন দুবাই প্রবাসী এক ছেলের কাছে। ছেলেরা ৫ ভাই সব আলাদা আলাদা। বিয়ের পর যাতে রাত বিরাতে বিশেষ প্রয়োজনে বাহিরে যেতে না হয়, এজন্য ছেলে এটাচ বাথরুম সহ বিল্ডিং করে দিয়ে দুবাই গেছে যে মাস ছয়েকের বেশী হয়েছে। হঠাৎ ছেলের বড় ভাই সহ কজন মিলে বিল্ডিংয়ের দেয়াল ভেঙে ফেলছে যাতে করে সর্বলোকে বাথরুম ব্যবহার করতে পারে। এই নিয়ে কতোদিন ধরে কাইয্যা লেগেই আছে, আর সাথে আছে মেয়েটির বিশেষ ধরণের শারীরিক জ্বালাপোড়া।
ঢাকায় পপুলার হসপিটালে এসে দেখা গেলো মেয়েটির রেকটাল ক্যানসার-স্টেজ ওয়ান।
ডাক্তার- ভালো সময়ে আসছেন, ভালো হয়ে যাবে। আগে রেডিয়েশন দিতে হবে, সাথে মাইল্ড কেমোথেরাপি ও চলবে, তারপর অপারেশন করে রেকটামের বাইপাস করে, সপ্তাহ তিনেক পরে বাইপাস খুলে দিয়ে মেইন লাইন আবার অপারেশন করে জোড়া লাগানো হবে. তারপর কেমোথেরাপী। ভালো হয়ে যাবে, দ্রুত রেডিয়েশন দেন।
খরচাপাতি-রেডিয়েশনে খরচ হবে লাখ দেড়েকের মতো, প্রথম অপারেশনে দেড় লাখ, মাস খানের দ্বিতীয় অপারশনে লাখ খানেক।
দ্বিতীয় অপারেশন করতে করতে ৪ লাখের জায়গায় ৮ লাখ শেষ। সব শেষ আর কিছু নাই বলতে বলতে চোখ দিয়ে টর টর করে পানি পড়ছিলো ভাইয়ের।
কয়েক সপ্তাহ থেকে পোষ্ট অপারেশনাল জটিলতায় ভুগছেন মেয়েটি। ডাক্তারের কাছে আবার এসে টেষ্ট করে দেখে পরের অপারেশনে জোড়া লাগেনি ভালো করে, কেমো শুরু করার কথা মাস খানেক আগে তাও শুরু করেনি। তাই ডাক্তার সাহেব রাগ করেছেন। কথাই বলছেন না; বলছেন যে সব রোগী কথা শোনে না তাদের উনাদের কাছে না আসুক।
বাবা-মা দুজন ডাক্তারের পায়ের উপর পড়ে আপাতত আবার হসপিটালে এডমিশন নিলো। হয়তো কদিন অবজারভেনে রেখে আবার সেই কাটা জায়গা কেটে আবার দেখবে, সাথে চলছে কিছু হাই এন্টিবায়োটিক।
কেমো দিতে আরো দশ লাখ টাকা লাগবে, সেই জোগান নাই, ৬ মাসে বীদেশ থেকে জামাই ৩ লাখ টাকা পাঠিয়েছে, আর বাকীটা একজন দিনমজুরের সারা জীবনের জমানো টাকা, বড় বড় ৪-৫ করই আর মেহগনি গাছ বিক্রির টাকা। আত্মীয়স্বজনের কাছে এখনো চাওয়া বাকী আছে-আরো লাখ দুয়েক ব্যবস্থা করতে পারবেন। তবে আরো লাখ দু-তিনেক খরচ করত পারবেন মেয়ের জন্য শেষ সম্বলটুকু দিয়ে হলেও বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
এই সংকটে পরিপূর্ণ মুহূর্তে কোন একজন তাকে এক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের পরিচয় দেই। সেই ডাক্তার বাবা তাকে শেষ সম্বল ৩-৪ লাখ টাকা কেমোথেরাপির জন্য খরচ না করে তার কাছে থেকে চিকিৎসা সেবা নেবার পরামর্শ দেয় শত ভাগ গ্যারান্টি সহকারে মাস দুয়েকের মধ্যে।
অতি স্বল্প খরচে; প্রতিবার গেলে ২ বা ৩ হাজার টাকার ঔষধ দেয় ১৫ বা ২০ দিনের জন্য।
-আমার এতো টাকার কেমো দেবার দরকার আছে, ২০-৩০ হাজারে আমার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে। তবে ভাই আমি হোমিও খাওয়াইতেছি কেমোর বদলে এইটা গোপন, কোন ডাক্তাররে বলি নাই।হোমিও ডাক্তারের নিষেধ আছে। ভাই আপনে আমার এক এলাকার মানুষ আমি আপনারে ফোন করে জানাবো যে আমার মেয়ে হোমিওতে ভালো হয়ে গেছে। আপনে দেইখেন।
একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে মানুষটারে আমার বুঝানো উচিৎ যে, আধূনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে হোমিও প্যাথিকে এক ধরণের প্রতারণা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এর বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নাই। রসায়ন, পদার্থ দুটোর কোনটাই এই চিকিৎসা শাস্ত্রকে সমর্থন করে না কোন ভাবে।
বারংবার
-আমনের কি মাথা খারাপ নি ভাই। প্রতারণা হইলে জেলায় জেলায় এতো হোমিওপ্যাথি কলেজ ও হসপিটাল সরকারে কেন বানাইছে, নোয়াখালীতে একটা, ফেনীতে একটা, চাদপুর, কুমিল্লা আরো জেলায় জেলায় সরকারী হসপিটালে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার নিয়োগ দিতেছে কেন? বলেন তো ভাই, আপনে তো দেশের কোন খবরই রাখেন না। দেশের ২০-৩০ টা হোমিওপ্যাথি হসপিটাল আছে। এসব তার ডাক্তারের কথা।।
কথা অনেক লম্বা হয়ে গেছে; এবার চলেন হোমিওপ্যাথিকে কেন ফ্রড বিবেচনা করা হয়। যে তিনটি মূল নীতির উপর হোমিওপ্যাথরা রোগীরা ঔষধ বানান তা একজন মানুষে বোধগম্য হতে চরম কষ্ট হবে; এটা এক ধরণের খোনারী, জ্বীন মিলানোর মতো। নোবোডি নোজ হাউ মেডিসিন ওয়ার্ক, সবাই বলে রহস্যময়।
-১- **লাইক কিউরস লাইক**: এইটা এক নম্বর নীতি। সংক্ষেপে: একদিন হ্যানিম্যান সাহেব এক গাছের পাতা খেয়ে দেখেন যে শরীরে এমন কিছু লক্ষণ দেখা দিলো যেটা প্রায় ম্যালেরিয়ার লক্ষনসমূহের মতো। কিছুদিন আগে তার ম্যালেরিয়া হয়েছিলো তাই তার ম্যালেরিয়ার লক্ষন তার জানা ছিলো। তখনই, যাদের ম্যালেরিয়া হয়, তাদের এই পাতা খাবার পর দেখলেন তাদের ম্যালেরিয়া ভালো হয়ে যায়। সেই থেকে তার হাইপোথেসিস: একই ধরণের প্রভাব সৃষ্টিকারী লঘুকৃত ঔষধ কাউকে খাওয়ালে সেই ধরনের প্রভাব সৃষ্টিকারী অসুখ টি ভালো হয়ে যায়। আর এজন্য ডাক্তাররা শুধু সিম্পটম খোজে।
-২- **লঘুকরণ (ডাইলুশন)**: অধিকাংশ হোমিও ঔষধের গায়ে ঘনমাত্রা লেখা থাকে 30C, C মানে Centesimal। ৩০সি এর মানে হলো ধরেন এক ইউনিট (যেমন: ড্রপ বা মিলিলিটার) একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট যোগ করা হলো ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ ইউনিট (যেমন: ড্রপ বা মিলিলিটার) পানিতে, মানে ঘনমাত্রা (১০^(-৬০))=৩০ সি। তারপর আবার আমাদের দেশে ডাক্তারের কাছে এসে চলে আরো কয়েক দফা ডাইলুশন। ঔষধ হয়ে যায় আরো শক্তিশালী; এতো শক্তিশালী ক্যান্সার ভালো, ইনফারটিলিটি দূর করে ফেলে।
30C লঘুকরণ আরেকটু খুলে বলি। এক ড্রপ ঔষধ যদি আপনার বাড়ির পাশে পুকুরে ফেলে কোন ভাবে সব পানি ঝাঁকান তাও ৩০সি এর সমান লঘু হয় না।
দীঘি, খাল এক করে ফেলেন তা ও হবে না, এবার নদীতে যান, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, পদ্মা যে কোন নদীতে এক ড্রপ ঔষধ ফেলে সমান ভাবে মিশালে ৩০সি ঘনমাত্রায় পৌছাবে না এমন কি সাগরে ও না। ভাবছেন আমি রসিকতা করছি, একটু ও না। ইউ ক্যান গুগল ইট, রিড সাম জার্নাল, ফাইন্ড ২০০সি ডাইলুশন-এটাও তাদের অনেক ওষুধের ঘনমাত্রা ।।
তাদের ধারণা যত পাতলা করা হবে ঔষধ ততো বেশী কার্যকর হবে। পৃথিবীর কোন সাধারণ মানুষ ইহা বিশ্বাস করবে কিনা আমি জানি না। এতো পাতলা একটা ঔষধ কিভাবে
কেমোথেরাপীর বিকল্প হয় যেখানে ক্যানসার কোষ বাড়ে অস্বাভাবিক ভাবে। এজন্যই মনে হয় খরচ ও কম, কাজ করে নাকি অনেক আস্তে, পুঁজি ও কম লাগে।
আর হোমিওতে ওভারডোজ বলে কিছু নেই, ডোজই যেখানে নেই ওভারডোজ কোত্থেকে আসে। টেড টকে দেখেছি, জেমস রেন্ডি হোমিওর জ্বরের বড়ি যেখানে দিনে একটা খাবার কথা সেখানে ৩০ বড়ির সব এক সাথে খেয়ে বলছেন, ৩০ মিনিটস গন আই ফিল নাথিং। আর আপনে নাপা একটার জায়গা ৮-১০ টা খেলে কি হবে চিন্তা করছেন?
আর যে ট্রাইট্রেশন করেছে, সে কি এই ডাইলুশনে বিশ্বাস করবে?
-৩-সাকাশন (Succussion) মানে ঝাঁকানো। এই ক্ষেত্রে যতো ঝাঁকি ততো নেকী। লঘুকরনের প্রতি ধাপেই ডানে-বাঁয়ে-উপরে নিচে, কাত করে চিত করে, উল্টো সিধা ঝাকাতে হবে। কেউ বলে তুলতুলে নরম জায়গায় ঝাঁকাতে হবে। এতো ঝাকানোর কারন হলো, ঘনমাত্রা নামতে নামতে (লঘুকরণ) এত এতো এতো এতো এতো নিচে চলে আসে যে তা অ্যাভোগেড্রোর সংখ্যার বহু বহু বহু বহু নিচে চলে গিয়ে একটা সিঙ্গেল ওষধ মলিকুল ও পানিতে অবশিষ্ট থাকে না। প্রতি ধাপে বিশেষ পদ্ধতিতে ঝাকানির ফলে ওষধ মলিকুল কোন না কোন ধাপে পানির
অনুর সাথে যখনই একবার ধাক্কা খায়, তখন লঘুকরণের ফলে পানির
মলিকুল গুলো ওষধ মলিকুলের ধাক্কার ঘটনা মেমরিতে ধারণ করে তার কার্যকারিতা রোগির শরীরে কার্যকর করে। ইজনট ইট ফানি? কানাডার এক টিভি নিউজে দেখেছি, তারা বাজারের হোমিও ঔষধের মাস স্প্রেক্টস্পকপিক সহ নানান অ্যানালাইসিস করে ও কোন অ্যাক্টিব ইন্গ্রেডিয়েন্টের অস্তিত্ত্ব পায় নি। তারপর ফ্রান্সের মূল কারখানায় গিয়ে
ও দেখে একই। তারা বলে: হোমিওপ্যাথি ইজ মিসটিরি।
অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারীভাবে ঘোষনা দেয় যে, স্বাস্থ্য সেবায় হোমিওর কোন প্রভাব নাই। মূল ধারার চিকিৎসার রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে হোমিও চিকিৎসাকে গ্রহণ করতে আমেরিকার স্বাস্থ সংস্থ্যার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
অনেকেই বলে হোমিওপ্যাথি আসলে ছোট চিনির বড়ি আর পানি ছাড়া কিছুই না। আবার অনেকে বলে প্লাসিবো ইফেক্ট, মানে ডাক্তার আপনারে ঔষুধের নামে চিনি বড়ি খাওয়ালে ও আপনার এতো বিশ্বাস, এই বিশ্বাসের কারনে মনে হচ্ছে, আই ফিল বেটার!!!
বাচ্চাকাচ্চাদের ঘুমের মধ্যে কথা বলা, রাতে কাথায় প্রশ্রাব করা, খাউজানি, চুলকানি ধরণের রোগের জন্য হোমিও ইজ ফাইন।
কিন্তু, হেপাটাইটিস বি, সি, কিডনির সমস্যা বা থাইরয়েড এধরনের বড় অসুখের জন্য হোমিও খাওয়া মানে আস্তে আস্তে নিজের অসুখটাকে পেলেপুষে বড় করা ছাড়া কিছু নয়।
সরকারী উদ্যোগে দেশে ৪০ টা হোমিও কলেজ আছে বলেই হোমিও ক্যান্সার ভালো করার মতো এতো উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতিতে পরিনত হয়নি। আধূনিক মূল ধারার চিকিৎসা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়, হোমিও এক নিয়মেই চলছে।
কালকে যে ১২০০ টাকা ভিজিট দিয়া আপনার বা আপনার বাচ্চাকে নিয়ে হোমিও ডাক্তারের কাছে যাবার কথা, তো আপনে যাবেন কিনা একটু ভেবে দেখেন।!!
হোমিও অনুরাগী কাউকে মনে কষ্ট দেবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ও নাই তবে আমার কোন তথ্যে ভুল পেলেতা জানালে উপকৃত হবো।
ধন্যবাদ
Comments
Post a Comment