তারপর ও যেতে হবে সেখানে সব সময় মাটির টানে, নাড়ির টানে

তারপর ও যেতে হবে সেখানে সব সময় মাটির টানে, নাড়ির টানে..(লেখাটি লিখা প্রথম আলোর জন্য)
২০১৫ সালের ২০ ই ডিসেম্বর। আমেরিকায় টানা ৩ বছর কাটানোর পর প্রথম দেশে যাচ্ছিলাম। টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাষ্টার্স সময় থেকে পরিকল্পনা পিএইচডি শুরু করলে প্রথম সেমিষ্টারেই দেশে যাবো। যেই চিন্তা সেই কাজ। পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে ২-১ সপ্তাহ ক্লাস করে সব প্রফেসরের সাথে কথা বলে সেমিষ্টার ফাইনালের তারিখ নিশ্চিত করে তাই একটু দেরী হয়ে গেলো। এজন্য কিনতে হলো দাম দিয়ে কষ্টের ভ্রমন। ইতিহাদ এয়ার লাইন্সে, প্রায় ৩৬ ঘন্টার ভ্রমন, সাথে আছে তামজীদ, গন্তব্য ঢাকা । সিকাগো ওহারে এয়ারপোর্ট থেকে মেনচেষ্টার , ৮ ঘন্টা যাত্রা বিরতি, মেনচেষ্টার থেকে আবুধাবি এয়ারপোর্ট, আবার যাত্রাবিরতি ৮ ঘন্টা, তারপর, আবুধাবি থেকে ঢাকা। কমল দাদা পার্ডু ভিলেজ থেকে পার্ডু মেমোরিয়াল ইউনিয়নে এক্সপ্রেস এয়ারকোচ স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আসলেন, সাড়ে বারোটার দিকে, তারপর সিকাগো ওহারে এয়ারপোর্টে বাসে যেতে প্রায় ৩ ঘন্টা। ঢাকার পল্লবী-ধলেশ্বরী বাসের লাইনের মতো বিশাল লম্বা অাঁকাবাঁকা লাইন, তাই ফ্লাইটের ৪ ঘন্টা আগে আসা। চেক-ইন করতে গিয়ে অনেক বাঙ্গালির সাথে পরিচয়, সবাই দেশে আসছেন ভিন্ন ভিন্ন এয়ার লাইন্সে। একটি বিমানের সাড়ে চারশ যাত্রীর মধ্যে পরপর তিনটি সিটেই যে কাকতালীয় ভাবে তিনজন বাংলাদেশী যাত্রী বসবেন এমন কখনো ভাবিইনি। আমার ডানে Ball State University এর পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর মুন্নি বেগম, দেশে যাচ্ছিলেন কোন এক কন্ফারেন্সে যোগ দিতে আর ডানে জনৈক আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার। নানা ধরণের আলাপ চারিতায় বিমানে প্রথম ১৪ ঘন্টা খুব সহজেই কেটে গেলো। পূর্ব পরিচিত ৫-৭ জন বাংলাদেশী স্টুডেন্টের সাথে দেশীয় আমেজে আড্ডায় কেটে গেল ম্যানচেষ্টার এয়ারপোর্টের ৮ ঘন্টার ট্রান্জিট। ম্যানচেষ্টার থেকে আবুধাবি যাবার পথে বিমানের পাশের সিটে ভ্রমন সঙ্গী দুবাইয়ের কোন এক ধন-কুবেরের ছেলে সুলাইমান, লন্ডনে কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমাদের কয়েক ঘন্টা আলাপচারিতার মাথায় বিমান বালা খাবার নিয়ে আসলেন, খাবার খেয়েই নিশ্চিন্ত মনে কয়েক ঘন্টার ঘুম, তারপরই চলে আসলাম আবুধাবি এয়ারপোর্টে। এখানে এসে মনে হচ্ছে শরীরে একটু ক্লান্তি এসেছে। চোখ গুলোকে আর খুলে রাখতে পাচ্ছিলাম না। এয়ারপোর্টের সবগুলো আরামের সিট কারো না কারো দখলে। এদিক ওদিক একটি সুন্দর সিট খুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম, ফেসবুকে একটু ঢু মেরে আসতে চোখে পড়লো আমাদের কয়েক ব্যাচ সিনিয়র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের জাইদুর রশীদ সজীব ভাই আবুধাবী এয়ারপোর্টে মিনিট কয়েক আগে ফেসবুকে চেকিন দিলেন। উনাকে খুজে বের করে কয়েক ঘন্টা জমপেশ আড্ডা। আবুধাবী এয়ার পোর্ট থেকে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার জন্য বিমানে উঠার লাইনে দাড়ালাম যাত্রীদের কথা বার্তায় মনে হলো এ বিমানের সবাই বাংলাদেশী। বিমানের কর্মকর্তারা ইংরেজীতে বলছিলেন বিমানের সিটের উপর ভিত্তি করে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ক্রমধারা অনুযায়ী লাইনে দাড়াতে। মনে হলো কেউ তাদের কথা বোঝেনি। যে যার মতো করে অনেকটা লোকাল বাসের যাত্রীর মতো হৈহুল্লোড় করে বিমানে ঢুকেই সবাই বেজায় খুশী। অধিকাংশ যাত্রীই ইংরেজী না বুঝায় বিমানের সিট খুজে পাচ্ছিলেন না। প্রায় শত দুয়েকের ও বেশী যাত্রীকে সিট দেখাতে গিয়ে ৪-৫ জন বিমান বালা হিম শিম খাচ্ছিলো, আমিও সাহায্য করেছিলাম আশে পাশের বেশ কজন কে। মাত্র ৫ ঘন্টায় যখন ঢাকায় আসলাম, বিমানের প্রথম চাকাটি যখন মাটিতে লাগলো সুখের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। প্রত্যেক বার দেশের মাটিতে পা দেবার যে ভালো লাগার অনুভূতি মনে হয় সব সময় এমনই হয়। যথারিতী যে যার মতো হৈহুল্লোড় করে বিমান থেকে নামছেন। প্রায় শেষ দিকে এক বিমানবালা আমাকে এসে বললেন, আমি যেন আমার সিটেই বসে থাকি। মনে মনে ভাবছি আমার লাগেজ হয়তো এখনো আসেনি, এর বেশী কিছু ভাবি নি, এই ফাঁকে খুব আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখছিলাম আর পুরো বিমানে আমি সহ আরো একজন যাত্রী। সাদা পোশাকে ওয়ারলেস ডিভাইস সহ দুই লোক এসে কোন কথাবার্তা না বলে্ই আমাকে তাদের সাথে এয়ারপোর্ট থানায় যেতে বললেন। আর খুব দ্রুত হেটে চলছেন। আমার হাতের দুটো ব্যাগ নিয়ে এত দ্রুত যেতে পারছিলাম না। বার বার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেন থানায় গিয়ে কথা হবে। অনেক দূর যেতে যেতে হঠাৎ লোকটি তার হাতের পার্সপোট দেখিয়ে বললেন আপনি এই লোকটা না? ছবি দেখে আমি বললাম না। তখনই তার মনে হলো তারা ভুল লোককে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি আবার দৌড়ে আসলাম আমাকে এমন হেনস্থার কারন খুজতে আর জানলাম যে, জনৈক ব্যক্তির আবুধাবী যাবার পথে ভিসা বাতিল হওয়ায় তার পার্সপোর্ট আগেই ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় , আর পরের ফ্লাইটে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।, নিজের অধীকারে একটু চেঁচামেচী করলাম,তাদের নাম লিখে রাখলাম; শাফায়েত, ,নাসের। আর সেই সুবাদে আমার উত্তেজনা থামাতে আমার হাতের ব্যাগ দুটো নিয়ে এগিয়ে দিয়ে গেলেন নিচ তলা পর্যন্ত। ৩৬ ঘন্টা বিমান ভ্রমনের কষ্ট গায়ে লাগেনি, আর নিজের দেশের মাটিতে ১০ মিনিটের ছোট্ট একটি ঘটনায় মনে হলো কয়েক বছরের ক্লান্তি আমার শরীরে। আমেরিকায় কন্ফারেন্সে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমন, কোথাও বেড়াতে যেতে অসংখ্যবার বিমান ভ্রমন করেছি, এহেন হেনস্থার শিকার এই প্রথম তাও নিজের দেশের মাটিতেই। এরকম কষ্টের স্মৃতি কখনো ভুলে যাবার নয়, তারপর ও আমার দেশ, আমার মা, মায়ের কাছে না গিয়ে কি থাকা যায়? যেতে হবে সেখানে সব সময় মাটির টানে, নাড়ির টানে।

Comments

Popular posts from this blog

Statement of Purpose এর নমুনা-13 ( Analytical Chemistry)

আমেরিকার যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এপ্লাই করতে জিআরই লাগে না, তার প্রাথমিক তালিকা_১ :

Statement of Purpose এর নমুনা-১ ( Organic Chemistry)