বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, অভ্যুত্থান, মারামারি, জানালা ভাঙ্গা আর রড সমাচার
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, অভ্যুত্থান, মারামারি, জানালা ভাঙ্গা আর রড সমাচার*******************************************************************
ডিসকভারি পার্কের Bindley Bioscience Center এ আমার রিচার্স ল্যাবোরেটরি। পার্ডু ভিলেজের বাসা থেকে হেঁটে ল্যাবে যেতে ১০ মিনিট সময় লাগে। Bindley এর পাশেই নতুন আরেকটা গবেষণাগার হচ্ছে। আমার ল্যাবের বিশাল খোলা জানালা দিয়ে পশ্চিমের আকাশ পুরোপুরি দেখা যায়। গত কয়-মাস থেকে কন্সট্রাকশন কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। দালান তৈরির জন্য কন্সট্রাকশন কাজের মূল কাঁচামালগুলোর একটি হলো লোহার রড। প্রতিদিন হেঁটে যেতে দেখা যায় একটি আবদ্ধ এলাকায় কিছু লোহার রড শুয়ে আছে, আবার কোথাও খাড়া হয়ে আছে। এত সুন্দর করে কেউ লোহার রড কাটতে পারে!! আমাদের দেশে দেখতাম কন্সট্রাকশন কাজে বিশাল হাতুড়ি আর বাটাল দিয়ে লোহা কাটতো। খাড়া-শোয়া এসব রড দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেলো।
আমেরিকায় আসার পর থেকে কতো মানুষের দ্বারা আমি উপকৃত হয়েছি তার কোন হিসাব নাই। দুএকটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা। ঢাকা-ইস্তাম্বুল-ওয়াশিংটন হয়ে যখন ক্যালিফোর্নিয়া এলাম, দেশী কাউকে চিনি না। ইউনিভার্সিটির ফেসবুক গ্রুপে এক ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়ে তার বাসায়ই মাথা গোঁজার ঠাই হয়। আবার, যার সাথে জীবনে কোনদিন দেখা বা কথা হয়নি, আরেক ভাই বিনালে বিঘাটে আমার জন্য ভাত রান্না করে বসে আছে। আবার আরেক দীর্ঘদিনের পরিচিত ভাইটি আমার ফান্ডিংসহ ভর্তির জন্য প্রফেসরের কাছে আমার জন্য সুপারিশের মতো উপকার কয়জন স্বেচ্ছায় করতে পারে। এছাড়া এমন অনেকে আছেন!!
যেই এত উপকারে উপকৃত আমি, সেই আমার সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করা ছোট ভাইটি যে কদিনের মাথায় হাতে এই রড হাতে নিয়ে তারই সহোদরের মতো সহপাঠীর মাথায় আর নালার মধ্যে পিটাবে না, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? সঙ্গদোষে লোহা ভাসে আমার নিজের চোখে দেখা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি এরকম জানালা কাটা রডের ব্যবহার। হলের পাতি নেতারা যে রুমে থাকে, হেক্সোব্লেড দিয়ে সব কটা রড সুন্দর করে কেটে রেখেছে। আর প্রতিপক্ষ ধাওয়া করলে জানালা দিয়ে দৌড়ে পালাবে আর সুযোগ পেলে জায়গা মতো আঘাত করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কেউ হয় জাতি গড়ার কারিগর, আর কেউ হয় পঙ্গু আবার কেউ নিজের জীবন বিসর্জন দেয় আবার তাদেরই কেউ আবার ওই জীবনই কেড়ে নেয়। কত জনকে মরতে দেখেছি। ছোট বড়কে সুন্দর হাতে হেক্সো ব্লেড দিয়ে কাটা রড দিয়ে উপর্যুপুরি মারছে, বড় ছেলেটি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, তাকে আবার উঠিয়ে আবার মারছে, আবার মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো, আর রক্তাক্ত শরীর, এভাবে চলছে দীর্ঘক্ষণ।একটা মায়ের ছেলে এত বর্বর হতে পারে!! অতি আগ্রহী আমি বর্বরতা দেখার জন্য এই গেইট থেকে ওই গেইটে দৌড়াচ্ছি। মোছওয়ালা শিক্ষক-জ্বী কাঁদছেন আর রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুচলেন, তবু ও সে্ রড ধরতে তিনি যাচ্ছেন না, রডকে গুরুজী ও ভয় পান আর দুদিন পরে পদত্যাগ করেন।
দুপক্ষের মারামারি আর দুর্ভোগ হয় সাধারণ ছাত্রের। পত্রিকার পাতায় আর টিভি চ্যানেলে স্ক্রোলে খবর চলে আসে আর মামা-চাচা-খালা-বন্ধু-বান্ধবের ফোন। পৃথিবীর সর্ব বিষয়ে অতি আগ্রহী আমার নানাভাই ফোন দিয়েই বলতেন- আহ দেশটা বুঝি গেলো রে গেলো, পড়াশোনা বুঝি আর হবে না, এরা কারা দেশটাকে বুঝি আর দাড়াইতে দিল না। ধাওয়া খাওয়া কতজন আবার বিশেষ তত্ত্বাবধানে পরীক্ষা দিতে ডিপার্টমেন্টে আসতেন। তাদের আবার ধরে সেই রডের বাড়ি দিতে বিপক্ষ দলের আবার এক গ্রুপ রড নিয়ে দাড়িয়ে থাকতো বাসস্ট্যান্ডে। পুরোটাই সার্কাসের মতো।
৬-৭ বছর আগের কথা। রসায়নের ভাষায় যদি বলি, একটা নতুন বন্ধন ভাঙলে আর একটা বন্ধন গড়বেই। রসায়নের আর কোন নিয়ম অনুসরণ না করেই শুধু এই নিয়মেই চলছে দীর্ঘদিন। এক গ্রুপ জোর-জবরদস্তি করে আসবে তো আরেকগ্রুপ পালাবে কিন্তু সমজোযী বন্ধনের মতো শেয়ার করে কেউ থাকতে রাজি নয়। একদল কে আরেক দল রড হাতে নিয়ে দৌড়ানোর সময় রড দিয়ে বাড়ি দিয়ে আমার জানালার গ্লাস টা দিলো ভেঙে, রাতে দুটা তিনটার সময় কাঁচ ভেঙে আমার শীতের রাতে লেপের উপর এসে পড়লো আর কনকনে শীত ঢুকছে জানালা দিয়ে । তোরা একজনের মাথার মগজ একজনে খা, আমি সাধারণ ছাত্রের কাঁচ ভাঙ্গার দরকার কি ছিলো ? আজো আমার ইচ্ছে করে সেই ছেলেটিকে হাতের কাছে পেলে জুতা আর ঝাড়ু দিয়ে দুটা বাড়ি দেই। আবার, কারো হাতে রড নেই তাই সেই জানালায় হাত দিয়ে আমার দরজা আটকানোর কাঠের টুকরাটা ও নিয়ে গেছে সুযোগ পেলে হয়তো কারো মাথায় দিবে সেই ভেবে। এসব নাকি গুরুজীদের ইশারায় চলে।
এসব বিদেশীর সাথে শেয়ার করার মতো নয়। এসব টয়লেটের বর্জ্যের মতো, কালো গল্প, খুনের গল্প, জীবন ধ্বংসের গল্প। আমেরিকায় এত সুন্দর সুন্দর জিনিষ থাকতে আমার চোখের কেন এই রড এসে পড়লো !!!! এই রড দেখলেই বর্জ্যের মতো গল্পগুলো স্মরণে চলে আসে।
Comments
Post a Comment